· দীপক রাজদান
আমাদের দেশে প্রশাসনিক সংস্কারের ফলে শ্রমিক শ্রেণীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতিরসম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত শ্রমিকদের কর্মজীবনের শেষে তাঁদের ইপিএফ-এরসঞ্চয়ের অর্থ পেতে বারবার ইপিএফ-এর অফিসে যেতে হ’ত। ইপিএফ-এর পেনশন প্রাপকদেরওতাঁদের পেনশন পাওয়ার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হ’ত। বিভিন্ন শিল্প সংস্থারপরিচালকরা প্রয়োজনীয় রেজিস্টারে যথাযথ হিসাবের মান্যতা দেওয়াকে, বোঝার মতো মনেকরতেন। কর্মচারী রাজ্য বিমা বা ইএসআই-এর চিকিৎসাকেন্দ্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরপরিষেবা পাওয়া ছিল দুরূহ ব্যাপার। কর্মবিনিয়োগ কেন্দ্রগুলিতে এত রকমের কাগজপত্র ওফর্মে বিভিন্ন ধরনের তথ্য ভরতে হ’ত, যে সম্ভাব্য কর্মপ্রার্থীরা তাঁদের নামনথিভুক্ত করাতে আসতে চাইতেন না।
কর্মীরা তাঁদের ইপিএফ অ্যাকাউন্টে সঞ্চিত অর্থ, চিকিৎসা, সন্তানের বিবাহ বাবাড়ি তৈরির জন্য তোলার সময়, অসহযোগী সরকারি কর্মী ও নানা ধরনের নিয়মকানুনের ফলেহয়রান হয়ে যেতেন। নথি সংরক্ষণে কোনও রূপ স্বচ্ছতা ছিল না। ফলে, এক্ষেত্রে সরকারিআধিকারিকদের ইচ্ছে মতো কাজের ও ক্ষমতা প্রয়োগের সমস্যা ছিল।
বিগত তিন বছরে শ্রম মন্ত্রক শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের অভিযোগগুলি ও সমস্যাকমাতে এক্ষেত্রে সার্বিক সংস্কারের ব্যবস্থা করেছে। কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী শ্রীবন্দারু দত্তাত্রেয় এমনকি ৪০ কোটি অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদেরও ইপিএফ এবংইএসআই-এর মতো সাময়িক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা প্রদানেরআশ্বাস দিয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠে শ্রমমন্ত্রক বর্তমানে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং প্রায় প্রতি সপ্তাহেই শ্রমিক শ্রেণীরজন্য কিছু না কিছু সদর্থক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। শ্রী দত্তাত্রেয় বলেছেন,দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও অসাম্য হ্রাস করা, ভারতের উন্নয়নেরকর্মসূচির প্রধান বিষয়।
একগুচ্ছ নতুন উদ্যোগের অঙ্গ হিসাবে শ্রম মন্ত্রক ইপিএফ-এর অর্থ প্রদানেরসময়সীমা ২০ দিন থেকে কমিয়ে ১০ দিন করার জন্য নির্দেশ জারি করেছে। এটা আগে ভাবাইযেত না। আগে যে কেবলমাত্র কর্মজীবনের মেয়াদপূর্ণ করার পর ক’ত পরিমাণ অর্থ পাওয়াহয়েছে, সেক্ষেত্রেই স্বচ্ছতার অভাব ছিল তাই নয়, ইপিএফ-এর গ্রাহকদের নিজেদের সঞ্চিতঅর্থ ফেরৎ পেতে প্রায় শাস্তিমূলক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হ’ত। অনুরূপভাবে, অভিযোগনথিভুক্ত ও তার সমাধানও ছিল প্রায় অসম্ভব। বর্তমানে অভিযোগ নিষ্পত্তির সময়সীমাবারবার কমিয়ে ২০ দিন থেকে ১৫ দিনে নামিয়ে আনা হয়েছে।
ইপিএফ গ্রাহকদের বর্তমানে তাঁদের বা পরিবারের সদস্যদের অসুস্থতার জন্যঅগ্রিম টাকা তুলতে কেবল একটি স্বেচ্ছা ঘোষণাপত্র দিলেই চলে। কোনও গ্রাহককে এখন আরঅগ্রিম অর্থ তোলার জন্য কোনও মেডিকেল বা অন্যান্য সার্টিফিকেট বা নথিপত্র বানির্দেশ পূরণ করতে হয় না। পেনশন প্রদানের কাজ ত্বরান্বিত করতে এবং সমগ্র ব্যবস্থায়নিয়মানুবর্তিতা আনতে ইপিএফও, গ্রাহকদের পরিচয়পত্রের সঙ্গে আধার সংযুক্তিকেবাধ্যতামূলক করেছে। সমস্ত ক্ষেত্রীয় অফিসকে ‘১৯৯৫ সালের কর্মী পেনশন প্রকল্পে’রনতুন সদস্যদের আধার যাতে কর্মসংস্থানকারীরা দেয়, তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়াহয়েছে। পয়লা জুলাই, ২০১৭ তারিখে এই নির্দেশ কার্যকর হয়েছে। ইতিমধ্যেই যাঁরা পেনশনপ্রকল্পে রয়েছেন, তাঁদের আধার সংযুক্তির কাজ হয়েছে এবং তাঁরা ডিজিটাল পরিচয়পত্রপেয়েছেন। এরফলে, স্বচ্ছতার সঙ্গে পেনশন প্রাপকদের অর্থ প্রদান নিশ্চিত হবে এবংপেনশন প্রদানকারী ব্যাঙ্কের কাছে প্রাপকদের সমস্ত তথ্য থাকবে, যাতে বিলম্ব বা কোনওঅজুহাত দেখানোর সুযোগ থাকবে না।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রক ২০১৭’র মে মাসে দ্রুত আর্থিক লেনদেন সুনিশ্চিতকরতে বৈদ্যুতিন বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে অর্থ হস্তান্তর ও প্রদানের বিষয়ে নির্দেশ জারিকরেছে। এই সব লেনদেনের মধ্যে রয়েছে – ইপিএফ-এর সুবিধা, পেনশন প্রদান ও বিমাসংক্রান্ত দাবি পূরণ। এই উদ্যোগের ফলে, সাড়ে চার কোটি ইপিএফ গ্রাহক এবং ৫৪ লক্ষপেনশন প্রাপক উপকৃত হবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
শ্রমিকদের নিজস্ব গৃহনির্মাণের স্বপ্ন পূরণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়াহয়েছে। আগেও শ্রমিকরা তাঁদের ইপিএফ-এর জমানো অর্থ গৃহনির্মাণের জন্য তুলতে পারতেন।কিন্তু বর্তমানে তাঁরা তাঁদের মাসিক কিস্তির টাকা ইপিএফ অ্যাকাউন্ট থেকে সরাসরিব্যাঙ্কে হস্তান্তর করতে পারবে। এরজন্য ইপিএফ সংগঠন, ২০১৭ সালের জুন মাসে হাডকো’রসঙ্গে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে। এই সমঝোতা অনুসারে শ্রমিক-কর্মচারীরা আবাসনসোসাইটি গঠন করতে পারবে, গৃহনির্মাণের জন্য টাকা তুলতে পারবে এবং সরাসরি ব্যাঙ্কবা গৃহনির্মাণকারী সংস্থাকে মাসিক কিস্তির টাকা দিতে পারবেন।
গৃহনির্মাণের জন্য অর্থ পাওয়ার যোগ্যতামান শিথিল করা হয়েছে এবং এর জন্যইপিএফ-এর গ্রাহক হিসাবে মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে তিন বছর করা হয়েছে। গ্রাহকরাপ্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার আওতায় বার্ষিক আয়ের যোগ্যতামানের নিরীখে আবাসন ও পুরএলাকায় দারিদ্র দূরীকরণ মন্ত্রকের নোডাল এজেন্সি হাডকো এবং ন্যাশনাল হাউজিংব্যাঙ্কের মাধ্যমে আবাসন ঋণের সুদের ক্ষেত্রে ২ লক্ষ ২০ হাজার টাকা পর্যন্তভর্তুকি পেতে পারবে।
দৈনিক মজুরির পরিমাণও সংশোধন করে আগের থেকে বাড়ানো হয়েছে। ‘সি’ শ্রেণীরঅকৃষি শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ২৪৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫০ টাকা করাহয়েছে। ‘বি’ শ্রেণীর ক্ষেত্রে এই মজুরি ৪৩৭ টাকা ও ‘এ’ শ্রেণীর ক্ষেত্রে ৫২৩ টাকাকরা হয়েছে।
২০১৫’র বোনাস প্রদান (সংশোধনী) আইন অনুসারে বোনাস প্রাপ্তির যোগ্যতামানবেতন মাসিক ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১ হাজার টাকা করা হয়েছে। কর্মচারী ক্ষতিপূরণ (সংশোধনী) আইন, ২০১৭ অনুসারে আইন লঙ্ঘনের জন্য শাস্তিমূলক জরিমানার পরিমাণ ৫হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। এই পরিমাণ প্রয়োজনে ১ লক্ষ টাকাওহতে পারে।
মাতৃত্বকালীন সুবিধা (সংশোধনী) আইন, ২০১৭ অনুসারে দুটি জীবিত সন্তানের জন্যমাতৃত্বকালীন ছুটি ১২ সপ্তাহ থেকে বাড়িয়ে ২৬ সপ্তাহ এবং দুই সন্তানের বেশিদেরক্ষেত্রে ছুটির সুবিধা ১২ সপ্তাহ করা হইয়েছে। এর ফলে, মহিলারা আরও বেশি করে কাজেযোগ দিতে উৎসাহ পাবে। ইএসআই নিগমের মেডিকেল পরিষেবা শিল্প ক্লাস্টার যুক্ত ৩৯৩টিজেলায় প্রসারিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩০১টি জেলায় এই সুবিধা সম্পূর্ণ রূপে পাওয়াযাচ্ছে। দ্বিতীয় পর্বে দেশের বাকি সবকটি জেলাকে এই পরিষেবার আওতায় আনারলক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। বিমাকৃত একজন ব্যক্তির জন্য দুটি ডিসপেনসারি থেকেচিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এরফলে, বিমাকৃত ব্যক্তি তাঁরকর্মসংস্থানকারীর মাধ্যমে নিজের জন্য একটি এবং পরিবারের জন্য অন্য আরেকটিডিসপেনসারির সুবিধা বেছে নিতে পারবেন। এরফলে, সমস্ত বিমাকৃত ব্যক্তি বিশেষ করেপরিযায়ী শ্রমিকরা, যাঁরা নিজ রাজ্যের বাইরে কর্মরত তাঁদের সুবিধা হবে। এতদিনপর্যন্ত দ্বিতীয় ডিসপেনসারি’র সুবিধা না থাকায় শ্রমিকদের পরিবারগুলি ইএসআই-এরচিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হ’ত। কর্মসৃজনের ক্ষেত্রে শ্রম মন্ত্রক, ন্যাশনালকেরিয়ার সার্ভিস বা এনসিএস প্রোজেক্ট নামে একটি গতিশীল মঞ্চের মাধ্যমে দেশেরজনকর্মসংস্থান পরিষেবাকে পরিবর্তন ও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে।
৩ কোটি ৮৭ লক্ষ কর্মপ্রার্থী এবং ১৪ লক্ষ ৮০ হাজার প্রতিষ্ঠান ন্যাশনালকেরিয়ার সার্ভিস পোর্টালে নথিভুক্ত হয়েছে। এরফলে, অন্তত ৬ লক্ষ শূন্যপদ একত্রিতকরা গেছে। ২০১৬-১৭’তে ৫৪০টি কর্মসংস্থান শিবিরের আয়োজন করা হয়েছে। এনসিএসপ্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে ১০০টি মডেল কেরিয়ার সেন্টার স্থাপন করে উচ্চমানের কর্মসংস্থানপরিষেবা দেওয়া হবে। রাজ্য সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে এইসেন্টারগুলি গড়ে তোলা হবে। কর্মীদেরই ইপিএফ অ্যাকাউন্টে কর্মসংস্থানকারীরা মোটবেতনের যে ১২ শতাংশ অর্থ দিয়ে থাকে, সরকার ৮.৩৩ শতাংশ হারে অর্থ নতুন কর্মীদেরপেনশন অ্যাকাউন্টে দিয়ে থাকে। বস্ত্রবয়ন শিল্প ক্ষেত্রে সরকার কর্মীদের বেতনেরবাকি ৩.৬৭ শতাংশ অর্থ কর্মসংস্থানকারীদের প্রদেয় কর্মীদের জন্য অ্যাকাউন্টে দিয়েথাকে। নতুন কর্মসংস্থানের জন্য এই প্রকল্পের ফলে তাই কর্মসংস্থানকারীদের সুবিধাহয়েছে। এর অতিরিক্ত হিসাবে সরকার কর্মসংস্থানের জন্য সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসাবেবস্ত্রবয়ন শিল্প ক্ষেত্রের জন্য ৬ হাজার কোটি টাকা উৎসাহদান প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
দেশের যুবকদের কর্মসংস্থান যোগ্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০টি মন্ত্রক ৭০টিক্ষেত্রে দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি চালাচ্ছে। দক্ষতা উন্নয়ন ও শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রকেরতথ্যে জানা গেছে ২০১৫-১৬ বর্ষে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ১.০৪ কোটি মানুষ দক্ষতা বৃদ্ধিরপ্রশিক্ষণ পেয়েছে।
· লেখক - “প্রেসিডেন্ট প্রণব : পাওয়ার অফ স্পীচ” বইয়ের লেখক। বর্তমানে তিনিনতুন দিল্লির ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা।
· এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণভাবে লেখকের ব্যক্তিগত।
PG /PB/ SB…