· গুরু প্রকাশ
“কর্মই ধর্ম, কিন্তু হাসিই জীবন। যে ব্যক্তি জীবনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন,তাঁকে অত্যন্ত খারাপভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। অন্যদিকে, যেব্যক্তি আনন্দ ও দুঃখকে সমানভাবে মেনে নেন, তিনিই জীবন থেকে সর্বশ্রেষ্ঠপ্রাপ্তিলাভ করেন”।
ওপরের এই বক্তব্যটিকে খুব সহজেই বাস্তব জীবনকে পরিত্যাগ করা এবং বৃহত্তরস্বার্থে জীবন উৎসর্গ করা, ধর্মজগতের কোনও সন্তের বক্তব্য বলে ভুল হতে পারে। এটাবিশ্বাস করা কঠিন যে, কথাগুলি ভারতের লৌহমানব সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের বহুঅরাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যে একটি।
প্রথম জীবন এবং কৃষক সংগ্রাম
গুজরাটের কাইরা জেলার নাদিয়াদ গ্রামে জাভেরিভাই ও লাদবাঈ প্যাটেলের কৃষকপরিবারে জন্মানো পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে একজন হিসাবে বল্লভভাইয়ের জন্ম হয়। ভারতেরস্বাধীনতা ও স্বাধীন ভারতের অখন্ডতার মতো এক সুদূরপ্রসারী এবং গুরুত্বপূর্ণস্বার্থ পূরণের জন্যই যেন তিনি তৈরি হয়েছিলেন। মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠার বছরগুলিতেতাঁর মানসিকতার ওপর মায়ের প্রভাব ছিল অপরিসীম। সাধারণ গ্রামীণ পরিবেশে মা সবছেলেমেয়েদের এক জায়গায় বসিয়ে রামায়ণ ও মহাভারতের গল্প বলতেন। এইসব কাহিনী যদিকিশোর প্যাটেলের মনোজগতে ধর্মীয় চেতনা জাগিয়ে থাকে, তা হলে তাঁর বাবা তাঁকে কৃষিজগতের সঙ্গে পরিচিত করেন। কিশোর বল্লভভাই তাঁর বাবার সঙ্গে ক্ষেতে যেতেন। শেষপর্যন্ত জমি চাষ ও গবাদিপশুর দেখভালের ক্ষেত্রে তিনি চৌকস হয়ে ওঠেন। কৃষিকার্যেরক্ষেত্রে এই দুটি দিকই বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। তাঁর কৃষক পূর্ব পুরুষদের নিয়ে এতটাইভালোবাসা ছিল যে একবার একজন আমেরিকান সাংবাদিক তাঁকে তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডবিষয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “আরেকবার প্রশ্ন করলে, আমিবলতে পারি, আমার সংস্কৃতি হচ্ছে কৃষিকাজ”।
প্রথম যে সংগ্রাম প্যাটেল’কে প্রকাশ্য জনজীবনে নিয়ে আসে, তা হল – কৃষক নেতাহিসাবে তাঁর কাজ। বারোদ এবং খেদা – এই দুই জায়গার সফল সত্যাগ্রহের মাধ্যমে তিনিস্বাধীনতা আন্দোলনে প্রবেশ করেন। এই সত্যাগ্রহ আন্দোলনে তিনি তাঁর নেতৃত্বেরব্যতিক্রমী দক্ষতা এবং ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের মাধ্যমে, অত্যাধিক খাজনাবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে বাধ্য করেন।
রাষ্ট্রনায়কোচিত কাজ এবং রাজনৈতিক বিচক্ষণতা
সর্দার প্যাটেল হচ্ছেন সেইসব নেতৃবৃন্দের মধ্যে একজন, যাঁরা শুধুমাত্র যেস্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রেখেছেন তাই নয়, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতীয়পুনর্গঠনের কাজের দিশা-নির্দেশ দিয়েছেন।
“আমরা স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে কঠোর পরিশ্রম করেছি; আমাদের এইস্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখতে আরও কঠোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে”।
স্বাধীন ভারতে যে অসামরিক, সামরিক এবং প্রশাসনিক আমলাতন্ত্রের এক ইস্পাতদৃঢ় কাঠামো দরকার, সর্দার প্যাটেল সে বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে সচেতন ছিলেন।সুসংগঠিত নেতৃত্ব-ভিত্তিক সেনাবাহিনীর মতোএকটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এবং বিধিবদ্ধ আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে তাঁরআস্থা দেশের পক্ষে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। প্যাটেলই প্রথম ভারতীয় নৌ-বাহিনীকেযথাসময়ে লাক্ষ্মাদ্বীপ বন্দরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কারণ, পাকিস্তানও সেই সময়েকৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই দ্বীপভূমিকে দখল করার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছিল। এখনকল্পনা করে দেখতে হয় যে, আমাদের প্রতিবেশী দেশটি তাঁদের পরিকল্পনায় সফল হলে আমাদেরকি অবস্থা হ’ত, তা বুঝতে। এছাড়া, পণ্ডিত নেহরুর সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্রে এটা পাওয়াযায় যে, ভারত ও চিনের মধ্যে নিরপেক্ষ ভূখন্ড হিসাবে স্বাধীন তিব্বতেরপ্রাসঙ্গিকতার কথা তিনি অনেক আগেই বুঝেছিলেন।
আরএসএস এবং সর্দার প্যাটেল
১৯৪৯ সালের ১৬ জুলাই টিআর ভেঙ্কটরামা’কে লেখা একচিঠিতে সর্দার প্যাটেল বলেছিলেন, “আমি নিজেই এই সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা যত আগেসম্ভব অপসারণের জন্য আগ্রহী ছিলাম ... আমি আরএসএস’কে বলেছিলাম যে, তারা যদি মনেকরে কংগ্রেস ভুল পথে চলেছে, তা হলে তাদের যে কাজটি করা উচিৎ, তা হল – কংগ্রেসকেভেতর থেকে সংস্কারের চেষ্টা করা”।
আরএসএস-এর দ্বিতীয় সরসংঘ-চালক এমএস গোলওয়ালকারসর্দার প্যাটেল’কে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন, “ভেঙ্কটরামাজি প্রমুখের মতো বন্ধুদেরসঙ্গে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি। তাঁর সঙ্গে কথা বলে এবং আমাকের কাজ বিষয়েপ্রাথমিক আলাপ-আলোচনার পর আমি আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য চেষ্টা করব। আপনারস্বাস্থ্যের অবনতির কথা জানতে পেরে আমি দুঃখ পেয়েছি। এই সংবাদে আমি উদ্বিগ্নহয়েছি। বর্তমানে দেশে আপনার মতো মানুষের সুযোগ্য নেতৃত্ব এবং সেবার বিশেষ প্রয়োজনরয়েছে। আমি আপনার দীর্ঘ এবং সুস্থ জীবনের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি। আমিআশা করি, আপনার সঙ্গে যথাসময়ে দেখা করতে পারব। তবে, আপনার শারীরিক অবস্থার উন্নতিহতে পারতো। হৃদয়ে গভীর অনুভূতিগুলি সবসময়ে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় না।আপনাকে এই চিঠি লেখার সময়ে আমার সেই অনুভূতি হচ্ছে”।
এই চিঠিপত্র থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, সর্দার‘বিরোধ ছাড়া আলোচনা’র ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। শুধু মাত্র বড় কথা থেকে আরও এগিয়েযাওয়ার একটি প্রয়োজন রয়েছে। এই বিষয়ে নিরপেক্ষ গবেষণার মধ্য দিয়ে সেই প্রয়োজনমেটানো সম্ভব।
“গান্ধীজি, নেহরু এবং প্যাটেল – এই তিন মূর্তিরমধ্যে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ছিলেন, একমাত্র বাস্তববাদী মানুষ। স্বাধীনতারঅব্যবহিত আগে ও পরে এই তিন ব্যক্তিত্বই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।অধিকাংশ ভারতীয়ই হয়তো জানেন না যে, সর্দার প্যাটেলের উদ্যোগ ছাড়া ভারতের মানচিত্র,আজ আমরা যেমনটা দেখি, তেমনটা হ’ত না। তাঁর প্রচেষ্টা ছাড়া ভারতের এক বিরাট ভূখন্ডবিভিন্ন ধরণের চক্রান্তের মধ্য দিয়ে ভেঙে বেরিয়ে যেত। তিনি প্রায় একক উদ্যোগে এইভাঙন প্রতিরোধ করেছিলেন। কেবলমাত্র যে একটি মাত্র জায়গায় তিনি তাঁর বিচক্ষণ নীতিরূপায়ণ করতে পারেননি, তা হল – কাশ্মীর এবং যার ফল আমাদের আজও ভোগ করতে হচ্ছে।গান্ধীজির পরে তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব, এমনকি কোনও কোনও সময়ে গান্ধীজির থেকেওভালোভাবে ভারতের তৃণমূল স্তরের কথা এবং সংস্কৃতি তিনি বুঝতেন। তিনি যদি স্বাধীনতারপর আরও একটি দশক বাঁচতেন, তা হলে বর্তমান ভারতে অনেকগুলি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হয়তোসমাধান হতে পারতো”। প্যাটেলের আসন্ন প্রকাশিতব্য জীবনী ‘দ্য ম্যান হু সেভড্ইন্ডিয়া’ (যে মানুষ ভারত’কে বাঁচিয়েছিলেন)-র লেখক হিন্দোল সেনগুপ্ত এই অভিমতপ্রকাশ করেছেন।
· লেখক – নতুন দিল্লির ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের সিনিয়ররিসার্চ ফেলো।
· এই নিবন্ধে প্রকাশিত বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে লেখকেরনিজস্ব, এতে পিআইবি’র মত প্রতিফলিত হয় না।
PG /PB/ SB